প্রচলিত অডিট মূলত দেখে একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন আইন ও মানদণ্ড মেনে তৈরি হয়েছে কি না। কিন্তু ফরেনসিক অডিট হলো এর চেয়েও অনেক গভীর একটি প্রক্রিয়া। এটি শুধু হিসাব মেলানো নয়—বরং প্রতিটি লেনদেনের ভেতরে লুকানো প্রতারণা, দুর্নীতি, জালিয়াতি কিংবা অর্থ অপব্যবহার চিহ্নিত করার অনুসন্ধান। এ কারণে অনেকেই ফরেনসিক অডিটকে “ফিনান্সিয়াল ইনভেস্টিগেশন” বা আর্থিক গোয়েন্দাগিরি বলেন।
উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক:
ধরুন, একটি ব্যাংক হঠাৎ করে আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ মুনাফা দেখাল। প্রচলিত অডিট বলবে—সব হিসাব নিয়ম অনুযায়ী ঠিক আছে। কিন্তু ফরেনসিক অডিট খুঁজবে— হঠাৎ মুনাফা বাড়ল কেন? ঋণ বিতরণ বা আদায়ে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি? ভুয়া ঋণের নামে টাকা বাইরে পাচার হলো কি না? নাকি মুনাফার অংক কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে দেখানো হলো শেয়ারহোল্ডারদের বিভ্রান্ত করার জন্য?
ফলাফল দাঁড়ায়- ফরেনসিক অডিট শুধু সংখ্যা নয়, এর পেছনের আসল সত্য বের করে আনে।
কেন ফরেনসিক অডিট দরকার? ব্যাংক খাতের সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে- ৯৪% বিশেষজ্ঞ মনে করেন প্রতিটি ব্যাংকে আলাদা ফরেনসিক অডিট টিম থাকা জরুরি। এর কারণ হলো:
- প্রতারণা ও জালিয়াতি দ্রুত ধরা যায়।
- অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতিতে স্বচ্ছতা আসে।
- গ্রাহক ও আমানতকারীদের আস্থা বাড়ে।
শুধু ব্যাংক নয়- রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত, অবকাঠামো প্রকল্প—সবখানেই এর প্রয়োজন আছে।
ফরেনসিক অডিটের প্রধান ক্ষেত্রসমূহ:
- অর্থ চুরি বা আত্মসাৎ।
- ভুয়া ঋণ বা ভুয়া লেনদেন।
- কর ফাঁকি।
- মানহীন বা বিলম্বিত প্রকল্প।
- তহবিল পাচার।
- দেউলিয়া ও ব্যবসা বন্ধ সংক্রান্ত বিরোধ।
- বিবাহবিচ্ছেদ বা কর্পোরেট মূল্য সংক্রান্ত মামলা।
ফরেনসিক অডিটর কেমন হন?
একজন ফরেনসিক অডিটর কেবল হিসাবরক্ষক নন।
তাকে একই সঙ্গে-
- অডিটর (হিসাব বিশ্লেষণ করেন),
- গবেষক (তথ্য খুঁজে বের করেন),
- গোয়েন্দা (অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করেন),
- আইনি বিশেষজ্ঞ (কোর্টে সাক্ষ্য দিতে সক্ষম) হতে হয়।
তাই এর জন্য অ্যাকাউন্টিং ছাড়াও প্রয়োজন হয় মনোবিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি এবং অপরাধতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান।
ফরেনসিক অডিট থেকে কী শিখবে একজন ব্যাংকার?
স্বচ্ছতা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সংখ্যা সবসময় সত্য বলে না—সংখ্যার পেছনের গল্প বুঝতে হবে। যেখানে দুর্নীতির ঝুঁকি বেশি, সেখানে ফরেনসিক অডিট অপরিহার্য। এটি শুধু অতীতের অনিয়ম খুঁজে বের করে না, ভবিষ্যতের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও নির্দেশ করে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রমাণ করে দিয়েছে- শুধু প্রচলিত অডিট যথেষ্ট নয়।
ফরেনসিক অডিট হলো একটি অপরিহার্য হাতিয়ার, যা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হলে গ্রাহক আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে।