বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করার পর অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখে ইউরোপের পথে পা বাড়াতে চায়। Erasmus Mundus Joint Master Degree (EMJMD) স্কলারশিপ তাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি ভালো অপশন – যা ফুল্ ফান্ডেড, একাধিক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ এবং একটি বৈশ্বিক ক্যারিয়ারের সম্ভাবনার হাতছানি দেয়।
কিন্তু আফসোসের বিষয়, প্রতিবছর শত শত বাংলাদেশি মেধাবী আবেদনকারী আবেদন করেও রিজেক্ট হন। অনেকেই প্রশ্ন করেন - "আমার ভালো সিজিপিএ আছে, ভালো IELTS স্কোর আছে, ইউনিভার্সিটিতে পড়াই কিংবা রিলেটেড কাজের অভিজ্ঞতাও আছে – তবুও কেন রিজেক্ট হলাম?"
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আজকের এই লেখা – যাতে তুলে ধরার চেষ্টা করব সেইসব বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া তথ্য, যা অনেকটা চোখ খুলে দেয়ার মতো!
১. আবেদনপত্রে প্রাথমিক মারাত্মক ভুলগুলো
Erasmus Mundus-এর একটি প্রোগ্রামে আবেদনকারীদের একটি বড় অংশ প্রাথমিক ধাপেই বাদ পড়ে যায় শুধু কিছু সাধারণ ভুলের জন্য। যেমন:
• ৫ পাতার মোটিভেশন লেটার, প্যারাগ্রাফহীন, মার্জিন ছাড়াই, এবং বানানে ভরা ভুল!
• IELTS স্কোরশিটের স্ক্রিনশট (!!!)
• অস্পষ্ট সিভি ও সার্টিফিকেট
• প্রথম ও দ্বিতীয় রেফারেন্স লেটার একদম হুবহু একরকম
• সঠিক রেফারেন্স ফর্ম না পূরণ করে নিজের মতো করে চিঠি আপলোড
• এপ্লিকেশনে নিজের জন্মতারিখ ভুল দেওয়া (শত বছরের ডিফ্রেন্স)
• কোথাও কোথাও নিজের নামের বানানেও ভুল লেখা
- এসব ভুল শুধু তথ্যগত নয়, বরং আপনার মনোযোগহীনতা, পেশাদারিত্বের অভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে।
________________________________________
২. ‘মেধা’ থাকলেই স্কলারশিপ পাওয়া যায় না
একটা বড় ভুল ধারণা হলো – "আমার সিজিপিএ ৩.৯ (আউট অফ ৪.০), আমি নিশ্চিত Erasmus Mundus স্কলারশিপে পেয়েই যাবো!"
- না, Erasmus Mundus শুধু একাডেমিক রেজাল্ট দেখে না। তারা দেখে আপনি কতোটা গবেষণামুখী, কতটা চিন্তাশীল, কিভাবে আপনার অভিজ্ঞতা প্রোগ্রামের সাথে খাপ খায়, এবং আপনি ইউরোপ থেকে শিখে কীভাবে রিলেভ্যান্ট কমুনিটিতে অবদান রাখতে পারবেন।
মাথায় রাখুন - আপনার মোটিভেশন লেটারই হলো প্রধানতম অস্ত্র যা আপনাকে স্কলারশিপ পাইয়ে দিতে পারে- যদিও আপনার প্রোফাইল এভারেজ হোক না কেন! মোটিভেশন লেটারটাই যদি কপি-পেস্ট করা হয় বা আপনার ব্যক্তিত্ব তুলে না ধরে, তাহলে রেজাল্ট যত ভালোই হোক – নিশ্চিত রিজেকশন।
৩. রেফারেন্স লেটার: শুধু বড় পদে থাকা শিক্ষক নয়, দায়িত্ববান মানুষ থেকে নিন
অনেকেই ভাবেন, প্রফেসর সাহেব/ডিন সাহেব রেফারেন্স দিলে বিষয়টি “খুবই ওজনদার” হবে। কিন্তু বাস্তবে কি তিনি সময়মতো প্রোগ্রামের পাঠানো ফর্মটি পূরণ করবেন? যদি না করেন, আপনার আবেদনই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এবং শুরুতেই আপনার এপ্লিকেশন রিজেক্ট!
তাই বরং এমন কাউকে রেফারি হিসেবে দিন, যিনি আপনাকে সত্যিই চেনেন এবং সময়মতো দায়িত্ব পালন করতে পারেন – এমনকি তিনি পদের দিক থেকে জুনিয়র হলেও।
৪. ভ্রান্ত তথ্যে বিশ্রী প্রভাব
আবেদনে এমনসব তথ্য আবেদনকারীরা লিখে যা অনেকসময় খুবই হাস্যকর ও দুঃখজনক—
উদাহরনঃ “২১২২ সালে গ্র্যাজুয়েশন!” – ২০২২ সাল হবে; “বয়স ৭৩ বছর এবং মাত্রই ব্যাচেলর শেষ করেছে! - বয়স ২৩ বছর হবে”; “খুবই গরীব – এতিম, তাই ইরাসমুস স্কলারশিপ দিলে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে”, ইত্যাদি।
এসব ভুল হয়ত টাইপিং মিসটেক কিংবা আবেগী ভুল, কিন্তু স্কলারশিপ প্যানেলের চোখে আপনি তখনই অমনোযোগী এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রার্থী হিসেবে চিহ্নিত হবেন।
৫. সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব
বাংলাদেশে অনেক শিক্ষার্থী জানেই না কোথা থেকে শুরু করবে, কীভাবে আবেদন লিখবে, কোথায় গুরুত্ব দেবে। এই ক্ষেত্রে Erasmus Mundus সিনিয়র এলামনাই, সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ, স্টাডি গ্রুপগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আবেদনকারীরা নিজেরা সেগুলো ভালোভাবে ফলো করলেই এই জাতীয় ভুল করা থেকে মুক্ত থেকে রিজেকশনের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব।
তাহলে করণীয় কী?
১. সঠিকভাবে গাইডলাইন পড়ুন – প্রোগ্রাম অনুযায়ী নিয়ম আলাদা হতে পারে।
২. মোটিভেশন লেটার প্রস্তুত করুন – একাধিকবার সংশোধন করে, একদম নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দিয়ে।
৩. রেফারি নির্বাচন করুন সতর্কভাবে।
৪. সিভি ও সার্টিফিকেট স্ক্যান করুন পরিষ্কারভাবে।
৫. সময়ের মধ্যে সবকিছু সাবমিট করুন।
৬. এলামনাই বা অভিজ্ঞদের সাথে যোগাযোগ রাখুন, কিন্তু নিজের দায়িত্ব নিজে নিন।
এই লেখার শেষে এসে বলতে চাই –
আপনি যদি মনে করেন Erasmus Mundus আপনার জন্য নয়, কারণ আপনি BUET/ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি বা আপনার GPA পারফেক্ট নয় – তাহলে আপনি সেই ফাঁকিবাজদের দলে, যারা নিজদের অলসতা লুকানোর জন্য একটা না একটা এক্সকিউজ খুঁজে বাহির করেই! অযথা নিজেকে ছোট করবেন না!
EMJMD স্কলারশিপ এমন একজনকেই চায় যিনি সফলতার পেছনে দৌড়ায় না, বরং নিজের উন্নয়নে কাজ করে — ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেয়, সাহস রাখে, প্রস্তুতি নেয় এবং তারপর মাথা উঁচু করে বলে – “আমি প্রস্তুত”।
আপনার যাত্রা শুরু হোক আত্মবিশ্বাস আর সচেতনতা নিয়ে। আপনার কন্ঠেই একদিন শুনতে চাই - "Yes, I made it to Erasmus Mundus!"