সাধারণ বুকজ্বালা ভেবে যে সমস্যাটিকে আপনি বছরের পর বছর ধরে এড়িয়ে যাচ্ছেন, সেটি হয়তো তার চেয়েও বেশি কিছু। চলুন, আজ গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন আর উত্তরের মাধ্যমে GERD-এর রহস্য ভেদ করি এবং এর থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করি।
প্রশ্ন ১: আমার তো শুধু ভারী বা ঝাল খাবার খেলেই বুক জ্বলে। এটাই কি GERD?
উত্তর: না, সব বুকজ্বালা GERD নয়!
খাবার খাওয়ার পর অস্বস্তি বা বুকজ্বালা হতেই পারে। কিন্তু যদি এই সমস্যাটি আপনার পিছু না ছাড়ে এবং সপ্তাহে দুই বা তারও বেশি দিন ধরে আপনাকে ভোগায়, তবে একে সাধারণ সমস্যা ভাবার ভুল করবেন না। তখনই একে গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD) বলা হয়। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা, নিছক সাময়িক অস্বস্তি নয়।
প্রশ্ন ২: আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু পাকস্থলীর অ্যাসিড কেন বারবার খাদ্যনালীতে ফিরে আসে? সমস্যাটা কোথায়
উত্তর: সহজ কথায়, আপনার খাদ্যনালী ও পাকস্থলীর মাঝখানের "প্রবেশদ্বার" বা ভালভটি দুর্বল হয়ে গেছে। এই ভালভটির নাম লোয়ার ইসোফেজিয়াল স্ফিংটার (LES)। এর কাজ হলো খাবারকে পাকস্থলীতে যেতে দেওয়া, কিন্তু অ্যাসিডকে ওপরে আসতে বাধা দেওয়া। যখন এই প্রবেশদ্বারটি ঢিলে হয়ে যায় বা ঠিকমতো বন্ধ হয় না, তখনই পাকস্থলীর শক্তিশালী অ্যাসিড উল্টো পথে যাত্রা শুরু করে এবং আপনার বুকে ও গলায় জ্বালাপোড়া তৈরি করে।
প্রশ্ন ৩: GERD-এর লক্ষণ কি শুধু বুকজ্বালা আর টক ঢেকুর? নাকি আরও কিছু আছে?
উত্তর: চমৎকার প্রশ্ন! অনেকেই GERD-এর নীরব লক্ষণগুলো চিনতে পারেন না। বুকজ্বালা ছাড়াও নিচের সমস্যাগুলো GERD-এর কারণে হতে পারে:
🔸অকারণে কাশি: বিশেষ করে রাতের বেলা বা শোয়ার পর শুকনো কাশি।
🔸গলার স্বর বসে যাওয়া বা গলা খসখসে হয়ে যাওয়া।
🔸গলায় কিছু আটকে আছে এমন অস্বস্তিকর অনুভূতি।
🔸ঢোক গিলতে কষ্ট বা ব্যথা হওয়া।
🔸ঘন ঘন গলা পরিষ্কার করার প্রবণতা।
🔸অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া।
🔸দাঁতের ক্ষয় বা মুখে দুর্গন্ধ হওয়া।
আপনি যদি এগুলোর কোনোটিতে ভোগেন, তবে এর পেছনের কারণ GERD হতে পারে!
প্রশ্ন ৪: তাহলে এর থেকে মুক্তির উপায় কী? জীবনভর কি শুধু অ্যান্টাসিড খেয়েই কাটাতে হবে?
উত্তর: একদমই না! অ্যান্টাসিড হলো আগুন নেভানোর জন্য এক গ্লাস পানি, কিন্তু আগুনের উৎস বন্ধ না করলে তা আবার জ্বলবেই। GERD থেকে স্থায়ী মুক্তির জন্য আপনাকে আগুনের উৎস, অর্থাৎ রোগের মূলে কাজ করতে হবে। এর জন্য রয়েছে একটি "লাইফস্টাইল-ফার্স্ট" অ্যাপ্রোচ ও সঠিক খাবার-দাবার-পানীয় এবং ন্যাচারাল মেডিসিন।
মিশন GERD কন্ট্রোল: আপনার ৫টি অব্যর্থ কৌশল
✅খাবারের প্লেট সাজান নতুন করে : ভাজা-পোড়া, অতিরিক্ত চর্বি, ঝাল, কফি, চকলেটকে বিদায় জানান। খাদ্যতালিকায় যোগ করুন কলা, শসা, ওটস, আদা এবং সবুজ শাকসবজি।
✅খাওয়ার অভ্যাসে আনুন পরিবর্তন : একবারে পেট পুরে না খেয়ে, অল্প পরিমাণে বারে বারে খান। খাওয়ার সাথে সাথে পানি পান না করে কিছুক্ষণ পর করুন।
✅‘স্মার্ট স্লিপিং’ অভ্যাস করুন : খাওয়ার অন্তত ৩ ঘণ্টা পর ঘুমাতে যান। বিছানার মাথার দিকটা ৬-৮ ইঞ্চি উঁচু করে দিন। এতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিই অ্যাসিডকে নিচে রাখতে সাহায্য করবে।
বদভ্যাসকে ‘না’ বলুন :
ধূমপান এবং মদ্যপান আপনার LES ভালভকে আরও দুর্বল করে দেয়। আজই এগুলো ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিন।
ওজন কমান ও ফিট থাকুন :
পেটের অতিরিক্ত চর্বি পাকস্থলীর উপর চাপ তৈরি করে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখলে GERD-এর উপসর্গ নাটকীয়ভাবে কমে আসে।
যখন জীবনযাত্রার এই পরিবর্তনেও পুরোপুরি কাজ হয় না, তখন চিকিৎসক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিছু ন্যাচারাল ওষুধ দিতে পারেন যা অ্যাসিড উৎপাদন কমায় এবং খাদ্যনালীকে সেরে ওঠার সুযোগ দেয়।
শেষ কথা
GERD আপনার জীবনের আনন্দ কেড়ে নেওয়ার জন্য আসেনি। এটি বরং একটি সতর্কবার্তা যে, আপনার শরীরে এবং জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। সঠিক জ্ঞান ও কয়েকটি স্মার্ট অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে আপনিই হতে পারেন আপনার স্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রক। তাই আর দ্বিধা নয়, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন এবং বুকজ্বালাহীন এক স্বস্তির জীবনে ফিরে আসুন।