হাড়ক্ষয় এবং প্রতিরোধ

Osteoporosis and prevention


হাড়ক্ষয়ের সাথে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়েছে বেশিদিন হয় নি।

হাড়ক্ষয় একেবারে কোর লেভেলে একটা এইজিং প্রসেস। আপনার বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড়ক্ষয় বাড়ে, ফ্র‍্যাকচার বাড়ে, বিশেষ করে চল্লিশ বছর বয়সের পর। একসময় এটা নারীদের সমস্যা বলে পরিচিত ছিল কিন্তু এখন এটা সবার সমস্যা।

বায়োমেড সেন্ট্রাল ১১৬০৩ জন ডায়বেটিস রোগীর ওপর হওয়া ২১টা স্টাডির মেটা এনালাইসিস করে বলছে, শতকরা ২৭% এর বেশি ডায়বেটিক রোগী কোন না কোন ধরনের অস্টিওপরোসিস বা হাড়ক্ষয়ের সমস্যায় ভুগছেন।

ডায়বেটিকদের কেন এতবেশি হাড়ক্ষয় হয়, এটা নিয়ে এখন নতুন একটি হাইপোথিসিস আলোচনায় এসেছে। আমেরিকান কলেজ অফ ফিজিওলজিতে একটা অসাধারন রিসার্চ আর্টিকেল পাবলিশ করেছে, যেখানে দেখানো হয়েছে, ইনসুলিন যেহেতু একটা এনাবোলিক হরমোন, এটা আমাদের হাড় তৈরিকে নিয়ন্ত্রন করে।

আমাদের হাড় একপ্রকার সার্বক্ষনিক ভাঙ্গা গড়ার মধ্যে থাকে, ভাঙ্গার হার যদি গড়ার চেয়ে বেশি হয় তো হাড় পাতলা হতে শুরু করে। ইনসুলিন নতুন হাড় তৈরি করে এমন কোষ অস্টিওব্লাস্টের গ্রোথ বাড়ায়, ইনসুলিনের অনুপস্থিতিতে অস্টিওক্লাস্ট বা হাড় ভেঙ্গে ফেলে যে কোষগুলো, তাদের ক্রিয়া বেড়ে যায়। অর্থাৎ বোন ম্যাট্রিক্স টার্নওভারের সাথে ইনসুলিনের সরাসরি সম্পর্ক আছে।


এই আর্টিকেলে দেখানো হয়েছে ৪ ধরনের ইনসুলিন রিসেপ্টরের মধ্যে IRS-1 সরাসরি হাড়ের গঠন শক্তিশালী হওয়ার সাথে জড়িত। টাইপ-১ ডায়বেটিস রোগী, যাদের শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয় না তাদের হাড়ক্ষয় নিয়ে গবেষনা করতে গিয়ে গবেষকরা হাড়ক্ষয়ের কারন হিসেবে ৭টি হাইপোথিসিস আলোচনা করেন, এর মধ্যে ৫টাকে তারা খারিজ করে দেন। ১টা কারন সবচে বেশি যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয়েছে, সেটা হচ্ছে ডায়বেটিসের কারনে গ্রোথ হরমোন-ইনসুলিন লাইক গ্রোথ ফ্যাক্টর হরমোনের মধ্যে যে এক্সিস থাকে, সেটা ঠিকভাবে কাজ করে না। একারনে এই রোগীদের হাড়ক্ষয় বাড়ে এবং ইনসুলিন ইনজেকশান এই সমস্যাকে দূর করতে সক্ষম।

কিন্তু আমাদের অধিকাংশ রোগী তো টাইপ-২ ডায়বেটিসে ভোগা, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট। তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কি??

ব্যাপারটা হচ্ছে, আমাদের হাড়ও এইজিংয়ের সাথে সাথে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট হতে শুরু করে। অভাবনীয় মনে হলেও ব্যাপারটা সত্যি। হাড়ের মধ্যে ক্যালসিয়াম জমা হবে কি হবে না, এটা কন্ট্রোল করে কার্বোক্সিলেটেড অস্টিওক্যালসিন। অস্টিওক্যালসিন একটা হরমোনের মত।

ভিটামিন ডি ও কে-২, এই দুইটা ভিটামিনের অভাব অস্টিওক্যালসিনকে কমিয়ে দেয় বা তার কার্যকারিতা হ্রাস করে। অস্টিওক্যালসিন কমে যাওয়া মানে আপনার হাড় সহজে ভেঙ্গে যাবে, আর মেরামত হবে না।

ওদিকে, ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে ইনসুলিন রিসেপ্টরগুলো অকার্যকর হতে থাকে, ভিটামিন ডির শোষন ও ব্যবহার কমে যায়, প্যারাথাইরয়েড হরমোনের সিক্রেশন বাড়ে। এই ৩টা ব্যাপারই নতুন হাড় তৈরিতে বাধা দেয়।

এরপর, আমাদের হাড়ের যে বিল্ডিং ব্লক, কোলাজেন ও কোলাজিনেটেড বোন  মাইক্রোআর্কিটেকচার, সেটার ফর্মিং ইউনিট হচ্ছে ভিটামিন সি। ভিটামিন সি আমাদের গ্রোথ হরমোনকে সবচে ইউনিকলি স্টিমুলেট করে। এককথায় বলতে গেলে বলা যায়, ভিটামিন সি মানেই হচ্ছে নতুন, তাজা কোষের জন্মের বার্তা, আর নষ্ট কোষের ধ্বংস।

কেউ যখন এই নিউট্রিয়েন্টগুলোর অভাবে ভুগতে থাকে, স্বাভাবিকভাবেই তার বোন ইনসুলিন সিগন্যালিং বাধগ্রস্ত হতে থাকে, এবং পারটিকুলারলি IRS-1, GH-IGF Axis অল্টার্ড হতে শুরু করে।

এই ক্ষেত্রে টাইপ ২ ডায়বেটিস রোগীর হাড় ইনসুলিনের প্রতি সাড়া দেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে টাইপ-১ ডায়বেটিস রোগীর হাড়ের মত আচরন করতে শুরু করে এবং এর ফলে দেখা দেয় হাড়ক্ষয়৷ এছাড়াও উপরোক্ত কারনগুলি লক্ষ্য করলে স্পষ্ট বোঝা যায় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের সাথে সাথে বায়োলজিক্যাল এইজিং বেড়ে গিয়ে হাড়ের ভঙ্গুরতাও বাড়তে থাকে।

আমাদের অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ক্ষয় রোগীদের বেশিরভাগই ইউরোপ অ্যামেরিকার রোগীদের মত ১২০-২০০ কেজি ওজন নিয়ে আসেন না। আমাদের হাড়ক্ষয় রোগীদের গড় ওজন ৫০ কেজি থেকে ৯০ কেজির ভেতরে।

এতদিন পর্যন্ত আমরা হাড়ক্ষয়কে শুধুমাত্র ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত সমস্যা হিসেবেই দেখে এসেছি। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে জানা যাচ্ছে, আমাদের হাড়গুলিও মাসলের মতই। তারাও ভাঙ্গে গড়ে এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট হয়, তাদেরও বয়স বাড়ে।

তাহলে, হাড় ঠিক রাখতে গেলে কি করতে হবে??

হাড়ের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে হলে সবার আগে আমি বলবো গায়ে রোদ লাগান এবং ভারী জিনিস নাড়াচাড়ার অভ্যাস ধীরে ধীরে তৈরি করুন।

সবচেয়ে দ্রুত গতিতে হাড়ক্ষয় ঘটে নভোচারী বা এস্ট্রোনটদের। হাড়ক্ষয় থামাতে তাদেরকে স্পেশাল নিউট্রিয়েন্ট সাপ্লিমেন্টেশান দেয়ার পাশাপাশি নিয়মিত হেভি ওয়েইট ট্রেইনিং করানো হয়, আর আমার আপনার মত মানুষকে দেয়া হয় ক্যালসিয়াম, সর্বোচ্চ ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম আর মাসল রিলাক্স্যান্ট।

হাড় ঠিক রাখতে গেলে ওজন তুলতেই হবে। কিন্তু যার হাড় ভেঙ্গে যায় যায় অবস্থা বা ভিটামিন ডি খুবই লো, তারা এই পোস্ট পড়ে ডাক্তার/নিউট্রিশনিস্ট না দেখিয়ে এবং ফিজিও/ফিটনেস ট্রেইনারের পরামর্শ না নিয়ে আন্দাজে ওয়েট তুলতে গেলে বিপদে পড়বেন।

হাড়ের নিউট্রিয়েন্টের মধ্যে এক নম্বর হচ্ছে ফার্স্ট ক্লাস এমাইনো এসিডস, সোজা কথায় প্রানীজ প্রোটিন খেতে হবে।

এরপর আসবে যথাক্রমে ভিটামিন ডি, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে-২, জিংক, বোরন, কপার এবং আরো কিছু ট্রেস মিনারেল।

সাধারনের জন্য রেকমেন্ডেড ডোজ নানারকম হতে পারে কিন্তু ৪৫ বছর বয়সী, ৫.২ ফুট উচ্চতা ও ৬০ কেজি ওজনের একজন নারী যার হাড়ে ক্ষয় ধরতে শুরু করেছে, তার জন্য রেকমেন্ডেডেড ডেইলি ডোজ এখানে বলি।

  • ভিটামিন ডি-৪০০০ আইইউ/রোজ(ডি লেভেল টেস্ট না করে ৬ মাসের বেশি খাবেন না)
  • ভিটামিন কে-২-১০০ এমসিজি/রোজ
  • ভিটামিন সি-৫০০ এমজি করে দিনে ৪ ঘন্টা পরপর ৪ বার
  • এলেমেন্টাল ম্যাগনেসিয়াম/ম্যাগনেসিয়াম সাইট্রেট/ম্যালেট/গ্লাইসিনেট-৫০০ এমজি করে দিনে ২ বার বা ২৫০ এমজি করে ৪ বার
  • বোরন-৩ এমজি করে দিনে ২ বার
  • ক্যালসিয়াম-৬০০ এমজি করে দিনে একবার, দুপুরবেলা।

ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এবং সেলুলার এইজিং কমানোর সবচে ভাল উপায় হচ্ছে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং।

তাহলে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং আর ওয়েইট ট্রেইনিং করুন, সাথে নিন প্রয়োজনীয় ফুড সাপ্লিমেন্ট।

হাড়ক্ষয় প্রতিরোধের এটাই গোপন রহস্য।

إرسال تعليق

أحدث أقدم