বিশ্বায়নের এই যুগে প্রায় সব ধরনের ব্যাবসা বাণিজ্যই আন্তর্জাতিক। ব্যবসায়ীদের নানা প্রয়োজনেই বিদেশ থেকে পণ্য ক্রয় করতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ কাউকে চিনেন না। সেক্ষেত্রে বিক্রেতার একটা ঝুঁকি থেকে যায়। এই ঝুঁকি এড়াতে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা এই এলসি বা ল্যাটার ওব ক্রেডিট এর মাধ্যমে লেনদেন করে থাকেন।
রপ্তানিকারকের রপ্তানি করা পণ্যের মুল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তার লক্ষে আমদানিকারকের পক্ষ নিয়ে ব্যংক যে প্রত্যয়ন পত্র দেয় তাকেই এল সি বলা হয়।
বিদেশ থেকে কোনো পণ্য আমদানী করার চাইলে অবশ্যই ব্যাংকের মারফত এলসি করতে হবে। আন্তর্জাতিক বানিজ্যের ক্ষেত্রে একমাত্র বৈধ মাধ্যমই হল এলসি। এলসির মাধ্যমেই ব্যবসায়ীরা একদেশ থেকে অন্য দেশে পন্য আমদানি-রপ্তানি করে থাকে।
LC এর পূর্ণরূপ হলো: Letter of Credit / এলসি – লেটার অব ক্রেডিট
প্রথমেই একটু ধারণা নিয়ে নেই এই এলসি কি। এলসি (LC) হচ্ছে সংক্ষিপ্ত নাম যার সম্পূর্ণ করলে হয় লেটার অব ক্রেডিট (ইংরেজিতে) আর ইতালিতে এটিকে বলে লেত্তেরা ডিক্রেডিটো (Lettera di credito)। এলসি বা লেটার অফ ক্রেডিট হচ্ছে ব্যবসায়িক লেনদেন বা টাকা পরিশোধ করার একটি মাধ্যম বা প্রক্রিয়া। যা প্রায়ই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বা ব্যবসায়িক লেনদেরন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এই প্রক্রিয়াট সকলের কাছে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত এবং এলসি এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশ তাদের ব্যবসায়িক/আর্থিক লেনদেন করে থাকে।
আমদানি ও রপ্তানি ক্ষেত্রে টাকা পরিশোধ করার প্রয়োজন হয়। আর টাকা পরিশোধের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও গ্যারেন্টেড পেমেন্ট মেথড হলো লেটার অফ ক্রেডিট বা এলসি। LC কে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঝুঁকি কমানোর একটি হাতিয়ার বলা হয়।
লেটার অব ক্রেডিট কাকে বলে?
এলসি হলো আমদানিকারকের পক্ষ থেকে আমদানিকারকের ব্যাংক দ্বারা জারি করা একটি লিখিত নথি ইস্যু করে যার মাধ্যমে রপ্তানিকারককে আশ্বস্ত করা হয় যে ইস্যুকারী ব্যাংক উভয় পক্ষের মধ্যে পরিচালিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য রপ্তানিকারককে অর্থ প্রদান করবে। আমদানিকারক হল এলসির আবেদনকারী, আর রপ্তানিকারক হল সুবিধাভোগী।
সহজ ভাষায়, লেটার অব ক্রেডিট/LC হল একটি ব্যাঙ্ক দ্বারা বিক্রেতাকে দেওয়া একটি অর্থপ্রদানের অঙ্গীকার এবং এটি আবেদনকারী অর্থাৎ ক্রেতার পক্ষে জারি করা হয়। ক্রেতা হলেন আবেদনকারী এবং বিক্রেতা হলেন সুবিধাভোগী। যে ব্যাংক এলসি ইস্যু করে তাকে ইস্যুয়িং ব্যাংক হিসাবে উল্লেখ করা হয় যা সাধারণত ক্রেতার দেশে থাকে। যে ব্যাংকটি বিক্রেতাকে এলসির পরামর্শ দেয় তাকে অ্যাডভাইসিং ব্যাংক বলা হয় যা সাধারণত বিক্রেতার দেশে থাকে।
আমদানীকারক যখন কোন বৈদেশিক পণ্য আমদানী করতে চায় তখন আমদানীকারকের পক্ষে তার ব্যাংক রপ্তানীকারকের পণ্যমূল্য পরিশোধের নিশ্চয়তাস্বরূপ লেটার অব ক্রেডিট ইস্যু করে। ব্যাংক আমদানীকারকের পক্ষে রপ্তানীকারকের অনুকূলে এল সি খোলার প্রাক্কালে উক্ত এল সি মূল্যের সম্পূর্ণ বা একটি অংশ নগদ অর্থে আমদানীকারকের নিকট হতে মার্জিন হিসাবে সংরক্ষণ করে। পরবর্তীতে পণ্য খালাসের সময় আমদানীকারক অবশিষ্ট অর্থ পরিশোধ করে অথবা ব্যাংকের ঋণের মাধ্যমে পণ্য খালাস করে। ব্যাংক এরূপ এল সি খোলার জন্য আমদানীকারকের নিকট হতে নগদে কমিশন বা সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করে থাকে। তাছাড়া মার্জিন হিসাবে সংরক্ষিত অর্থও স্বল্প সময়ের জন্য লগ্নি করে সুদ অর্জন করে থাকে। সুতরাং আমদানীকারক ব্যাংককে এল সি খোলার বিনিময়ে কমিশন হিসাবে নগদ অর্থ দিয়ে থাকে এবং মার্জিন হিসাবে টাকার যোগান দিয়ে সুদ হিসাবে আয় করার সুযোগ দিয়ে থাকে। এতক্ষণ যা বললাম সব বইপুস্তকের ভাষা, এবার প্রেক্টিক্যাল কথাবার্তা বলি, ধরেন আপনি রপ্তানি কারক। আপনে ক্রেতার আদেশ অনু্যায়ী মাল বানাইবেন। মাল বানানোর পরে ক্রেতা যদি মাল নিতে অসম্মতি জানায় বা মাল নিয়ে যদি দাম দিতে না চায় এর নিশ্চয়তা হচ্ছে L/C (Letter of Credit) বাংলায় ঋনপত্র বলা যায়। L/C তে ক্রেতা মালের বর্ননা, পরিমান, মূল্য, ডেলিভারির সময়, মূল্য পরিশোধের শর্ত, ইত্যাদি উল্লেখ্য থাকে।
এলসি এর প্রকারভেদ:
1. Revocable LC (এটার শর্তাবলী পরিবর্তযোগ্য, এর প্রচলন খুবই কম)
2. Irrevocable LC (এটার শর্তাবলী পরিবর্তযোগ্য নয়)
3. Confirmed LC (একাধিক ব্যাংকের নিশচয়তা থাকে)
4. Transferable LC (অন্য ব্যাংকের নিশচয়তা থাকে না)
5. Divisible LC (হস্তান্তরযোগ্য)
6. Revolving LC (হস্তান্তরযোগ্য নয়)
7. Restricted LC
8. Red-clause LC
9. Green clause LC
10. Back to back LC
11. With Recourse LC
12. Without Recourse LC
এলসি খোলার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট
(১) এলসি করার জন্য একজন ব্যবসায়ীর প্রথমেই দরকার হবে একটি ট্রেড লাইসেন্স এবং এটি অবশ্যই আপটুডেট হতে হবে।
(২) সর্বশেষ অডিট রিপোর্ট
(৩) একটি গ্রহনযোগ্য আইআরসি (IRC-Import Registration Certificate)
(৪) স্থানীয় বাণিজ্য চেম্বার বা সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনের থেকে সদস্যপদ সার্টিফিকেট
(৫) আয়কর ছাড়পত্র বা নতুন কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য আয়কর ঘোষণা পত্র
(৬) মূসক নিবন্ধন সনদপত্র
(৭) আইএমপি ফরম
(৮) টিএম ফরম
(৯) চুক্তি ফরম
(১০) চার্জ ডকুমেন্ট
(১১) গ্যারান্টি ফরম।
এলসির জন্য আবেদনের পূর্বে উল্লেখিত কাগজপত্র গুলো সংগ্রহ করে রাখতে হবে। এছাড়াও আরও কিছু নথিপত্র দরকার হবে
(১) এলসি আবেদন ফর্ম
(২) ইনডেন্ট / পারফর্মা ইনভয়েস (PI)/ ক্রয় আদেশ / ক্রয় চুক্তি .
(৩) যথাযথভাবে ও সঠিকভাবে কার্যকর চার্জ নথি
(৪) যথাযথভাবে সিল ও স্বাক্ষরিত এলসি অনুমোদন ফরম (Letter of Credit Authorization Application Form)
(৫) বীমা সংক্রান্ত নোট
LC এর আরো কিছু প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট:
1. Bill of Lading
2. Airway Bill
3. Commercial Invoice
4. Insurance Certificate
5. Certificate of Origin
6. Packing List
7. Certificate of Inspection
এসব কাগজপত্র সংগ্রহ করার পর যে ব্যাংকে এলসি করতে ইচ্ছুক সেই ব্যাংকের নিকট কাগজপত্র গুলো দাখিল করতে হবে। অবশ্যই সেই ব্যাংকে একটি একাউন্ট থাকতে হবে।ব্যাংক কাগজপত্র গুলো যাচাই করে দেখবে। এর জন্য কয়েকদিন সময় নিবে ব্যাংক। এলসির সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলে ব্যাংক থেকে জানানো হবে।
লেটার অব ক্রেডিট কেন গুরুত্বপূর্ণ?
আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা একে অপরের সাথে পরিচিত নয়, তাই তাদের মধ্যে আর্থিক লেনদেনের জন্য প্রয়োজন একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। অর্থাৎ, আমদানিকারকদের পণ্য প্রাপ্তির আগে রপ্তানিকারকদের অর্থ প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আর এই প্রতিবন্ধকতা কমাতে এলসি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন লেটার অব ক্রেডিট হলো ক্রেতা (আমদানিকারক) ও বিক্রেতা (রপ্তানিকারক) এর মধ্যকার লেনদেনের একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি যা ব্যাংকের মাধ্যমে হয় এবং এটি ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়ের জন্য কাজ করে থাকে। এটি একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেনের পেমেন্ট পদ্ধতি যা উভয় পক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে।
ব্যাংকের সাথে এলসি বিষয়ক লেনদেন
প্রথম দিকে ব্যাংক এ পুরো টাকাটাই জমা দিতে হবে। ধরা যাক এলসি ভ্যলু ২০,০০০ ডলার। ব্যাংক এ আপনাকে ১৬ লাখ টাকা জমা দিতে হবে। তবে আস্তে আস্তে ব্যাংকের সাথে ব্যবসা বাড়লে তখন ১০-২০% মার্জিন দিয়ে এলসি খুলতে হবে। টাকার সাথে অন্যান্য কিছু ডকুমেন্টও দিতে হবে। যেমন:
- আপনার কোম্পানীর সব কাগজ (ট্রেড লাইসেন্স, টিন, ভ্রাট, আইআরসি)
- ইনডেন্ট/পিআই এর ৩/৪ টি কপি।
- সাপ্লায়ার কোম্পানীর ব্যাংক ক্রেডিট রিপোর্ট
- ইন্সুরেন্স কভার নোট (যে কোন ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে ইনডেন্ট দেখিয়ে ফি দিয়ে এটা নিতে হবে)
এরপর ব্যাংক আপনাকে এলসির একটা কপি দেবে। অরিজিনালটা পাঠিয়ে দেবে বিদেশে সাপ্লাইয়ারের কাছে।
এলসির মাধ্যমে লেনদেন যেভাবে হবে
সকল ব্যাবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে দুটি পক্ষ থাকে একজন ক্রেতা আর একজন বিক্রেতা। এলসির মাধ্যমে লেনদেন প্রক্রিয়া হবে নিম্নরুপঃ
(১) ক্রেতা প্রথমে বিক্রেতার সাথে যোগাযোগ করবেন
(২) ক্রেতা যে ব্যাংকে এলসি করতে ইচ্ছুক সেই ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করবেন
(৩) ইস্যুকৃত এলসি ব্যাংক থেকে বিক্রেতার পরামর্শকারী ব্যাংকের নিকট পাঠাবেন
(৪) বিক্রেতার পরামর্শকারী ব্যাংক এলসির কাগজপত্র গুলো বিক্রেতার নিকট পাঠাবেন
(৫) কাগজপত্র গুলো দেখে বিক্রেতা সীপমেন্টের তারিখ ক্রেতাকে জানাবেন। এবং সাথে সাথে বিক্রেতা লেনদেনের সকল কাগজপত্র পরামর্শকারী ব্যাংককে দেখাবেন।
(৬) পরামর্শকারী ব্যাংক কাগজপত্র গুলো ক্রেতা যে ব্যাংকে এলসি করেছেন সেই ব্যাংকে পাঠাবেন।
(৭) কাগজপত্র গুলো পর্যালোচনা করে এলসি ইস্যুকৃত ব্যাংক লেনদেনের ছাড়পত্র পাঠাবেন পরামর্শ দানকারী ব্যাংকের নিকট পাঠাবেন। এবং সাথে সাথে একটি ছাড়পত্র ক্রেতার নিকট পাঠাবেন। পরামর্শ দানকারী ব্যাংকও একটি ছাড়পত্র বিক্রেতার নিকট পাঠাবেন।
ছাড়পত্র পাওয়ার পর ক্রেতা-বিক্রেতা লেনদেনের জন্য প্রস্তুত।