টিনএইজ প্রেমের সমস্যা বাবা-মা কীভাবে হ্যান্ডেল করবেন? একমাত্র ভুক্তভোগী জানেন এটি কত বড় সমস্যা। তাই এ লেখার মাধ্যমে একজন উপকৃত হলেও ধন্য হবো।
১। প্রথমে নিজেকে সামলান।
টিনএইজ বাচ্চার প্রেমের খবর জানলে মা-বাবা সাধারণত খুব দ্রুত রিয়্যাক্ট করেন। সাধারণত তা হয় রাগারাগি, কান্নাকাটি, চেঁচামেচি, মারধোর। দয়া করে এগুলো করবেন না। শান্ত থাকুন। এ ধরনের সমস্যা কমন। আপনার বাচ্চার ক্ষেত্রে প্রথম হয়নি। তাই রাগারাগি বা খুব ইমোশোনাল আচরণ না করে ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটি হ্যান্ডেল করুন। এটা নিয়ে যত চেঁচামেচিই করুন না কেন সমস্যার সমাধান হবে না।বরং আপনার সন্তান আরো জেদি হয়ে উঠবে এবং কোনো কথা শুনবে না। তাই সবার আগে নিজেকে সামলান।
২। পার্টনারের সাথে আলোচনা করুন।
এ সমস্যার মুখোমুখি হলে স্বামী-স্ত্রী একান্তে তা কীভাবে মোকাবেলা করবেন সে ব্যাপারে আলোচনা করুন। এক্ষেত্রে মায়েরা অনেক সময় একটি ভুল করেন। তাহলো, ব্যাপারটি জানলে স্বামী রাগ করবেন ভেবে তা তাঁর কাছে গোপন রাখেন।নিজে নিজে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত বাচ্চার বাবা যখন জানতে পারেন তখন সমস্যাটি এত প্রকট হয়ে যায় যে, সমাধান অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই মা কিংবা বাবা যেই প্রথম ব্যাপারটি জানবেন, তিনি তা অপরজনকে জানাবেন। একার বুদ্ধিতে নয়, দুজনের বুদ্ধিতে সমস্যাটি মোকাবেলা করুন।
৩। সন্তানের সাথে খোলামেলা আলাপ করুন।
রাগারাগি না করে ব্যাপারটি নিয়ে সন্তানের সাথে খোলামেলা আলাপ করুন। বোঝার চেষ্টা করুন ব্যাপারটি কতদূর এগিয়েছে। তাকে নির্ভয়ে কথা বলার সুযোগ দিন। শোনার আগেই বিচারের রায় না দিয়ে তার বক্তব্য কী, কেন সে এ পছন্দে জড়ালো তা বলতে দিন। ওর বক্তব্য হয়ত আপনার পছন্দ হবে না, তারপরও শুনুন। এধরনের সমস্যা সমাধানে তার কথা শোনা অনেক কাজে লাগবে।
৪। ঠান্ডা মাথায় বোঝান।
তার বক্তব্য শোনার পর খুব ঠান্ডা মাথায় কেন আপনি এ সম্পর্ক সমর্থন করেন না তা বোঝান। বিপক্ষে বলার অনেক ক্লু ওর কথাতেই পেয়ে যাবেন। যেমন, যার সাথে সম্পর্ক তার অনিশ্চিত ভবিষ্যত, পারিবারিক ঝামেলা, যা ভবিষ্যতে সমস্যা করবে, এরকম অনেক ক্লু। তবে যাকে ওর পছন্দ তার বদনাম করবেন না, তার পরিবারকে টেনে এনে ছোটো কথা বলবেন না। এটি উলটো সমস্যা করবে। বরং ওকে বোঝান কেন এ সম্পর্ক প্র্যাকটিক্যাল নয়। ও যদি বুঝতে পারে আসলেই সম্পর্কটির ভবিষ্যত নেই তাহলে নিজেই সরে আসবে।
৫। টিনএইজ প্রেমের সমস্যা সম্পর্কে বলুন।
ওকে উদাহরণ দিয়ে টিনএইজ প্রেমে কী কী সমস্যা হয় তা বুঝিয়ে বলুন। আপনার আশেপাশেই এরকম উদাহরণ আছে। আমি গতকাল এধরনের প্রেমে কী সমস্যা হয় তা লিখেছি। চাইলে আমার পেইজ স্ক্রল করে তা পড়তে পারেন।
৬। ওর বন্ধুদের সাহায্য নিন।
এ বয়সের ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের কথা যত শুনে তার চেয়ে বেশি শুনে ওদের বন্ধু বা সমবয়স্কদের কথা। তাই ওর সবচে কাছের বন্ধবান্ধব বা কাজিনের সাথে কথা বলুন। তাদের অনুরোধ করুন ওকে বুঝিয়ে বলতে। ওরা বোঝালে কাজ হতে পারে।
৭। হুমকি দেবেন না।
অনেক মা-বাবা এধরনের সম্পর্কের কথা শুনে যার সাথে সম্পর্ক তাকে হুমকি দেন, ভয় দেখান, ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করেন। প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে এর ফলাফল নেগেটিভ। এতে দুজনে জেদ আরো বাড়ে এবং শুধু জেদের কারণে আরো গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
৮। বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করুন।
এরকম সমস্যায় পড়লে নিজেকে সন্তানের কাছে শত্রু বানাবেন না। বরং তার বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করুন। সে বিশ্বাস করবে, আপনি মান-সম্মান বা নিজ স্বার্থে নয়, ওর ভালোর জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। এরকম একটি জায়গা তৈরি করলে সে আপনার উপর আস্থা রাখবে এবং ভুল সম্পর্ক থেকে সরে আসবে।
৯। সবাইকে বলে বেড়াবেন না।
দয়া করে জনে জনে আলাপ করে পরামর্শ চাইবেন না। এতে আপনার সন্তান অপমানিতবোধ করবে এবং আরো জেদি হয়ে উঠবে। ফলাফল হচ্ছে, সম্পর্কচ্ছেদ না করে সে জিদ করে আরো বেশি জড়াবে।
১০। ওর অনুভূতিকে অপমান করবেন না।
টিনএইজ বাচ্চারা খুব অনুভূতিপ্রবণ। ওদের অনুভূতিতে আঘাত করলে ওরা কখনোই তা মেনে নেয় না। বরং উল্টো আচরণ করে। তাই ওর অনুভূতিকে আঘাত না করেই ওকে বোঝান। মাথায় হাত বুলান, বলুন, 'এ সম্পর্ক শেষ করার কষ্ট আমি বুঝি। কিন্তু জীবনের বাস্তবতায় আমাদের অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। তোমার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তোমাকেও মানতে হবে।'
১১। বিশ্বস্ত কারো পরামর্শ চাইতে পারেন।
জনে জনে না বললেও, খুব বিশ্বস্ত এবং আস্থা রাখা যায় এরকম কারো সাথে আলাপ করতে পারেন। যিনি পুরো প্রাইভেসি বজায় রেখে আপনাকে পরামর্শ দেবেন।
১২। ঘরে আটকে রাখবেন না: পড়াশোনা বন্ধ করবেন না।
পারতপক্ষে প্রেমের কারণে ওকে ঘরে আটকে রাখবেন না। যোগাযোগের এ যুগে চার দেয়ালের মাঝে আটকে রেখে প্রেম আটকে রাখা যায় না। ওকে স্কুল-কলেজে যেতে দিন। তবে তাকে একটি কথা বলবেন, তাহলো, ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি, এর অমর্যাদা করো না।‘ তার প্রতি এ শ্রদ্ধা ও আস্থা তাকে বন্দি রাখার চাইতে বেশি কাজ করবে বলে আমার ধারণা। তবে কতক্ষণ বাইরে থাকবে তা ঠিক করে দিন। যেমন, স্কুল বা কলেজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে হবে। অন্যকোথাও গেলে কোথায় যাচ্ছে তা জানাতে হবে। নির্ধারিত সময়ে বাড়ি ফিরতে হবে। এধরনের পরিস্থিতিতে কখনোই পড়াশোনা বন্ধ করবেন না।এতে তার জীবন ধ্বং*স হয়ে যাবে।
১৩। একে অন্যকে দোষ দেবেন না।
এধরনের সমস্যায় অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে দোষারোপ করেন। বিশেষ করে বাচ্চার মাদের দায়ী করা হয়। দয়া করে তা করবেন না। বরং দুজনে একসাথে সমস্যা মোকাবেলা করুন। নিজেরা ঝগড়াঝাটি করলে বাচ্চাকে সামলাবেন কখন?
১৪। ইট'স অ্যা পিউর মাইন্ড গেইম।
মনে রাখবেন, আপনার সন্তানকে এ সমস্যা থেকে বের করে আনার জন্য আপনি একটি মাইন্ড গেইম খেলছেন। এতে কে জিতবে আপনি না আপনার সন্তানের সর্বনাশা প্রেম? আপনি জিতবেন, যদি কৌশলী হন।যে কৌশলগুলোর কথা বলেছি সেগুলো প্রয়োগ করতে পারেন। মাইন্ড গেইম সাপ-লুডু খেলার মতো। একটি ভুল চাল দিলেন তো সাপ আপনাকে খেয়ে ফেলবে। তাই সাবধানে খেলুন। ভেবেচিন্তে খেলুন। আপনার জেতার উপর নির্ভর করছে সন্তানের ভবিষ্যত।
১৫। প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর।
অপ্রিয় সত্য হলো, টিনএইজ এমন একটি বয়স যখন কথা শোনানো খুব কঠিন। তাই সম্পর্কে জড়ালে তা থেকে সরিয়ে আনা খুব কঠিন। সেজন্য তাতে যাতে না জড়ায় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। এর জন্য যা করা দরকার তাহলো,
ক) টিন এইজে পা দিলেই সন্তানের সাথে এ ধরনের সম্পর্কের খারাপ পরিণতি নিয়ে খোলামেলা আচরণ করুন। আমার মেয়ে এ বয়সে পড়লে তার মা ব্যাপারটি নিয়ে ওর সাথে খোলামেলা আলোচনা করেছিলেন। এটি খুব কাজে লেগেছে।
খ) তার প্রতি সতর্ক নজর রাখুন। কার সাথে মিশছে খেয়াল রাখুন। বন্ধুদের মাঝে মাঝে বাসায় ডাকুন।তাহলে অনেক কিছু বুঝতে পারবেন। বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।
গ। স্মার্ট ফোন বা ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করুন। রাতে ঘুমানোর সময় ওর নাগালে এ দুটো বস্তু যাতে না থাকে তা নিশ্চিত করুন। বাসায় ওয়াইফাই থাকলে তা রাতে নির্দিষ্ট সময়ের পর বন্ধ রাখুন। মোবাইল সেট আপনার কাছে জমা দিতে বলুন। একেবারে প্রথমদিকে যদি এ নিয়মগুলো বেঁধে দেন ও মেনে নেবে। তাই স্মার্টফোন কিনে দেওয়ার আগেই এ শর্ত ক্লিয়ার করুন। গভীর রাতে বাচ্চার হাতে মোবাইল ফোন ‘ইবলিশ’ হয়ে উঠতে পারে।
শেষ কথা হচ্ছে, টিনএইজ সন্তানের প্রেমের কথা জানলে ঝাঁটা নিয়ে 'তোর প্রেম বের করছি' বলে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। লম্বা দম নিন, তারপর ভাবুন, 'আমি একটু যুদ্ধে নামছি এবং যুদ্ধে জিতে ঠান্ডা মাথা, গরম মাথা নয়। তাই আমার মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।'