দুপুরে খাওয়ার পর ক্লান্তি লাগার কারণ এবং এনার্জি ধরে রাখার উপায়

 দুপুরে খাওয়ার পর ক্লান্তি লাগার কারণ এবং এনার্জি ধরে রাখার উপায়
দুপুরে খাবার খাওয়ার পর শরীরে যে ক্লান্তি আসে বা ঘুমঘুম ভাব হয়, তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় পোস্টপ্র্যান্ডিয়াল সোমনোলেন্স (Postprandial Somnolence)। এটি একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রতিক্রিয়া, যা প্রায় সবারই হয়, বিশেষত দুপুরের খাবারের পর।​

ক্লান্তি লাগার প্রধান কারণসমূহ

রক্তে শর্করার ওঠানামা

ভাত, রুটি, চিনি, পাউরুটি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খেলে রক্তে দ্রুত গ্লুকোজ বাড়ে। শরীর তখন ইনসুলিন নিঃসরণ করে এই গ্লুকোজ কমানোর চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ায় যখন গ্লুকোজ হঠাৎ কমে যায়, তখন ক্লান্তি, মাথা ঝিমঝিম করা, মনোযোগের ঘাটতি দেখা দেয়।​

উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) যুক্ত খাবার—যেমন মিষ্টি স্ন্যাকস, রিফাইন্ড শস্য, চিনিযুক্ত পানীয়—রক্তে দ্রুত শর্করা বৃদ্ধি ঘটায় এবং তারপর দ্রুত কমে যায়, যা এনার্জি ক্র্যাশ সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা এমন খাবার খান যা রক্তে শর্করার মাত্রা তীব্রভাবে পরিবর্তন করে, তারা বেশি ক্লান্তি অনুভব করেন।​

হজম প্রক্রিয়ার প্রভাব

ভরপেট খাবার খাওয়ার পর হজমপ্রক্রিয়ায় শরীরের রক্ত বেশি কাজে লাগে। ফলে মস্তিষ্কে রক্তের সরবরাহ কিছুটা কমে যায়, আর তখনই ঘুমঘুম ভাব আসে। বড় খাবার খেলে এই প্রভাব আরও বেশি হয়।​

সার্কাডিয়ান রিদম বা শরীরের জৈব ঘড়ি

বেলা ১টা থেকে ৩টার মধ্যে শরীরের প্রাকৃতিক ছন্দেই একটু ঘুমঘুম ভাব আসে। এটাকে বলা হয় সার্কাডিয়ান ডিপ বা আফটারনুন স্লাম্প। এই সময়ে শরীরে সতর্কতা বাড়ানো হরমোন কমে যায় এবং ঘুম আনার হরমোন মেলাটোনিন বেড়ে যায়।​

হরমোনের পরিবর্তন

খাবার খাওয়ার পর শরীরে সেরোটোনিন এবং মেলাটোনিনের মতো ঘুম আনার হরমোন বৃদ্ধি পায়। বিশেষত উচ্চ ক্যালোরি বা কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবার এই হরমোনের মাত্রা বেশি বাড়ায়, ফলে ক্লান্তি আরও বেশি অনুভূত হয়।​

এনার্জি ধরে রাখার কার্যকর উপায়

সবজি বা প্রোটিন দিয়ে খাবার শুরু করুন

ভাত বা রুটি খাওয়ার আগে সালাদ, ডাল বা মুরগির মাংস খান। প্রোটিন কার্বোহাইড্রেটের সঙ্গে মিশ্রিত হলে রক্তে গ্লুকোজের প্রবাহ ধীর করে এবং রক্তে শর্করার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এতে গ্লুকোজ ধীরে বাড়ে এবং শক্তি অটুট থাকে দীর্ঘ সময়।​

খাবারের পর হাঁটুন

মাত্র ২-৫ মিনিট হাঁটলেই শরীর গ্লুকোজ ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, খাবার খাওয়ার পরপরই হাঁটলে রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ে এবং কমে, যা হঠাৎ স্পাইক বা ক্র্যাশ এড়াতে সাহায্য করে।​

খাবারের পর ৬০-৯০ মিনিট সময়ের মধ্যে হাঁটার সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যায়। এমনকি খাবারের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাঁটা শুরু করলে রক্তে গ্লুকোজ বৃদ্ধি সবচেয়ে কম হয়। নিয়মিত হাঁটা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করে এবং দীর্ঘমেয়াদী রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।​

পানীয় সচেতনভাবে বেছে নিন

চিনি দেওয়া কোমল পানীয় বা জুস রক্তে গ্লুকোজ হঠাৎ বাড়িয়ে দেয়। এর বদলে পানি, লেবুপানি বা চিনি ছাড়া চা খান।​

সুষম খাবার খান

ফল খেতে চাইলে সঙ্গে খান প্রোটিন বা চর্বি, যেমন আপেলের সঙ্গে বাদাম বা দইয়ের সঙ্গে বেরি। এতে গ্লুকোজ ওঠানামা কম হয়। প্রতিটি খাবারে প্রোটিন এবং ফাইবার অন্তর্ভুক্ত করা রক্তে শর্করার স্থিতিশীলতা বজায় রাখে এবং দীর্ঘ সময় পরিতৃপ্তি দেয়।​

খাবারের পরিমাণে নজর দিন

অল্প অল্প করে খেলে হজমপ্রক্রিয়ায় চাপ কম পড়ে, শরীরও থাকে হালকা। বড় খাবার বেশি ক্লান্তি সৃষ্টি করে।​

নিম্ন গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) খাবার বেছে নিন

নিম্ন GI খাবার—যেমন ডাল, কুইনোয়া, ওটমিল, ডিম, বাদাম, সবুজ শাকসবজি—রক্তে ধীরে ধীরে গ্লুকোজ ছাড়ে, যা স্থিতিশীল শক্তি প্রদান করে এবং ক্লান্তি কমায়। এসব খাবার দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে এবং চিনির আকাঙ্ক্ষা কমায়।​

যেসব খাবার এনার্জি দীর্ঘস্থায়ী রাখে

শক্তি বজায় রাখার খাবার: সেদ্ধ ডিম, ডাল, সবজি, মাছ, দই, বাদাম, ফল—এসব খাবারে থাকে প্রোটিন, আঁশ ও ভালো চর্বি, যা শক্তি ধরে রাখে দীর্ঘ সময়।​

যেসব খাবার ঘুমঘুম ভাব বাড়ায়: চিনিযুক্ত কোমল পানীয়, ভাজাপোড়া, অতিরিক্ত ভাত বা মিষ্টিজাতীয় খাবার শরীরে হঠাৎ শর্করার জোয়ার আনে, পরে দ্রুত কমে যায়, তখনই চেপে বসে দুপুরের ঘুম।​

আজ থেকেই শুরু করুন

আগামীকাল দুপুরে এই তিনটি কাজের যেকোনো একটি চেষ্টা করুন:​

খাবার শুরু করুন সবজি বা প্রোটিন দিয়ে

খাবারের পর ৫ মিনিট হাঁটুন

কোমল পানীয় বাদ দিয়ে পানি বা চা খান

মাত্র একটি অভ্যাসও নিয়মিত মেনে চললে দুপুরে খাওয়ার পরের ক্লান্তি অনেকটাই কমে যাবে, দিনের বাকিটা সময় এনার্জিও থাকবে অটুট। তবে যদি ক্লান্তি অত্যধিক বা নিয়মিত হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ এটি অ্যানিমিয়া, থাইরয়েড সমস্যা বা ডায়াবেটিসের মতো অন্তর্নিহিত সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।​

Post a Comment

Previous Post Next Post