Peritoneal TB, Intestinal TB - পেটটাকে 'সেকেন্ড হোম' বানাচ্ছে যক্ষ্মা! দিনের পর দিন সাধারণ অ্যাসিডিটি ভেবে এই বিপদ ডেকে আনছেন না তো? বিস্তারিত আলোচনা করছি-
গ্যাস, বদহজম, আর পেটের গড়বড়—এগুলো তো আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। দুটো অ্যান্টাসিড খেয়ে বা একটু নিয়ম মেনে চললেই সব ঠিক হয়ে যাবে, এমনটাই ভাবি আমরা। কিন্তু যদি এমন হয়, আপনার দীর্ঘদিনের পেটের অস্বস্তির পেছনে লুকিয়ে আছে এক নীরব ঘাতক, যা সাধারণ কোনো সমস্যা নয়, বরং যক্ষ্মার এক ছদ্মবেশী রূপ?
হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন! ফুসফুসকে ফাঁকি দিয়ে যক্ষ্মার জীবাণু গুলো আপনার পেটের ভেতর পাতছে তার গোপন সাম্রাজ্য। আসুন পরিচয় করিয়ে দেই "অ্যাবডোমিনাল টিউবারকিউলোসিস" (Abdominal Tuberculosis) বা পেটের যক্ষ্মার সাথে—এক মহান প্রতারক, যার লক্ষণগুলো আপনাকে খুব সহজেই বিভ্রান্ত করে দিতে পারে।
অ্যাবডোমিনাল টিবি: যখন যুদ্ধক্ষেত্র ফুসফুস নয়, আপনার পেট!
সহজ কথায়, যখন যক্ষ্মার জন্য দায়ী মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস নামক ব্যাকটেরিয়াটি আমাদের পেটের ভেতরের কোনো অঙ্গ বা অংশকে আক্রমণ করে, তাকেই অ্যাবডোমিনাল টিবি বলে। এটি মূলত দুই রূপে হানা দেয়:
১. ইন্টেস্টিনাল টিবি (Intestinal TB): এক্ষেত্রে জীবাণু সরাসরি আমাদের অন্ত্রকে (ক্ষুদ্রান্ত্র বা বৃহদন্ত্র) টার্গেট করে। অন্ত্রের ভেতরের দেয়ালে ঘা (ulcer) তৈরি করে, যা হজমপ্রক্রিয়াকে তছনছ করে দেয়।
২. পেরিটোনিয়াল টিবি (Peritoneal TB): আমাদের পেটের ভেতরের অঙ্গগুলোকে যে পাতলা পর্দা বা আবরণী (পেরিটোনিয়াম) সুরক্ষিত রাখে, সেই আবরণীতেই যখন সংক্রমণ হয়, তখন তাকে পেরিটোনিয়াল টিবি বলে। এর ফলে পেটের ভেতরে পানি জমে (ascites) পেট ফুলে যেতে পারে।
সেরা উপমা:
আপনার শরীর যদি একটি বিশাল ফ্যাক্টরি হয়, তবে আপনার পেট হলো তার 'ইঞ্জিন রুম', যেখানে মূল শক্তি উৎপন্ন হয়। ইন্টেস্টিনাল টিবি হলো সেই ইঞ্জিন রুমের ভেতরের পাইপলাইন বা মেশিনে মরিচা ধরিয়ে দেওয়ার মতো, যা উৎপাদন (হজম) বন্ধ করে দেয়। আর পেরিটোনিয়াল টিবি হলো পুরো ইঞ্জিন রুমের দেয়ালে ড্যাম্প লেগে যাওয়া বা দেয়ালে ফাটল ধরে পানি ঢোকার মতো, যা পুরো সিস্টেমকেই বিকল করে দেয়।
শরীর যখন বাজায় বিপদের ঘণ্টা: লক্ষণগুলো মিলিয়ে নিন!
অ্যাবডোমিনাল টিবিকে "The Great Deceiver" বা 'মহান প্রতারক' বলা হয়, কারণ এর লক্ষণগুলো আইবিএস (IBS), ক্রোনস ডিজিজ (Crohn's Disease) বা এমনকি ক্যানসারের লক্ষণের সাথেও মিলে যেতে পারে। সতর্ক থাকুন যদি নিচের লক্ষণগুলো দীর্ঘ সময় ধরে দেখা দেয়:
🔻খেয়ালিপনা পেট ব্যথা: ব্যথাটা কখনো চিনচিনে, কখনো তীব্র। নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই যখন-তখন ফিরে আসে।
🔻ওজন যেন অদৃশ্য শত্রু: ঠিকঠাক খাওয়া সত্ত্বেও ওজন মাপার কাঁটা কেবল নিচের দিকেই নামছে।
🔻সন্ধ্যার জ্বর: দিনের বেলা ঠিকঠাক, কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই গায়ে হালকা জ্বর আর শীত শীত ভাব।
🔻বদহজমের চরম পর্যায়: কখনো মারাত্মক কোষ্ঠকাঠিন্য, আবার কখনো দীর্ঘমেয়াদী ডায়রিয়া।
🔻পেট ফোলা: মনে হচ্ছে পেটটা বেলুনের মতো ফুলে আছে, বিশেষ করে পেরিটোনিয়াল টিবিতে পেটে পানি জমার কারণে এমনটা হয়।
🔻ক্ষুধার সাথে আড়ি: খাবারের প্রতি তীব্র অনীহা এবং সারাক্ষণ দুর্বল লাগা।
🔻পেটে গোটা বা চাকা: পেটে হাত দিলে মাঝে মাঝে চাকা বা দলার মতো অনুভূত হতে পারে।
গোয়েন্দাগিরি ও চূড়ান্ত আঘাত: কীভাবে ধরা হয় এবং চিকিৎসা কী?
এই ছদ্মবেশী শত্রুকে ধরতে চিকিৎসকদেরও প্রায় গোয়েন্দার মতোই কাজ করতে হয়।
রোগ নির্ণয়:
📍সিটি স্ক্যান (CT Scan) / আলট্রাসনোগ্রাম (USG): পেটের ভেতরের অঙ্গগুলোর পরিষ্কার ছবি দেখে সংক্রমণের গভীরতা, পেটে জমে থাকা পানি বা অন্ত্রের অস্বাভাবিকতা বোঝা যায়।
📍এন্ডোস্কোপি/কোলনস্কোপি (Endoscopy/Colonoscopy): ক্যামেরা যুক্ত নলের মাধ্যমে অন্ত্রের ভেতরের অবস্থা সরাসরি দেখা হয় এবং সন্দেহজনক স্থান থেকে টিস্যু নিয়ে বায়োপসি (Biopsy) করা হয়, যা রোগ নির্ণয়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা।
📍অ্যাসাইটিক ফ্লুইড অ্যানালাইসিস (Ascitic Fluid Analysis): পেটে পানি জমলে, সিরিঞ্জের মাধ্যমে সেই পানি বের করে পরীক্ষা করে যক্ষ্মার জীবাণু শনাক্ত করা হয়।
চিকিৎসা:
সুখবর হলো, এই রোগটি যত জটিলই হোক না কেন, সঠিক চিকিৎসায় এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। ফুসফুসের যক্ষ্মার মতোই অ্যান্টি-টিউবারকুলার থেরাপি (ATT) অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের একটি কোর্স (সাধারণত ৬-৯ মাস) সম্পন্ন করতে হয়।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ: কোনো অবস্থাতেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। কোর্স অসম্পূর্ণ রাখলে জীবাণু আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসতে পারে (MDR-TB), যা নিরাময় করা অনেক বেশি কঠিন।
শুধু ওষুধ নয়, শরীরকেও বানান দুর্ভেদ্য দুর্গ!
অ্যাবডোমিনাল টিবির বিরুদ্ধে যুদ্ধটা দ্বিমুখী। একদিকে ওষুধ জীবাণুকে মারবে, অন্যদিকে আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেতর থেকে লড়বে। তাই শরীরকে শক্তিশালী করতে:
🍃পুষ্টির বর্ম পরুন: সহজে হজম হয় এমন প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার (মাছ, ডিম, ডাল, স্যুপ), ভিটামিন ও খনিজ পদার্থে ভরপুর তাজা ফল ও শাকসবজি খাদ্যতালিকায় রাখুন।
🍃বিশ্রামকে দিন অগ্রাধিকার: শরীরকে regenerage বা পুনর্গঠনের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম দিন।
🍃মানসিক চাপকে করুন বাই-বাই: দুশ্চিন্তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। মেডিটেশন, হালকা ব্যায়াম বা পছন্দের কোনো কাজে মন দিন।
🍃নিয়মানুবর্তিতাই মূল শক্তি: প্রতিদিন ঠিক সময়ে ওষুধ খান এবং ডাক্তারের ফলো-আপ মিস করবেন না।
এধরনের টিবি হলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে একদল ব্যাকটেরিয়ার যুদ্ধ। ওষুধ যেখানে সরাসরি শত্রুকে আঘাত করে, সেখানে সঠিক জীবনযাত্রা ও পুষ্টি আপনার শরীরের সৈন্যবাহিনীকে (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) শক্তিশালী করে তোলে। এই দুইয়ের সমন্বয়েই আসে চূড়ান্ত বিজয়।
শেষ কথা
পেটের যেকোনো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাকে অবহেলা নয়, গুরুত্ব দিন। যদি ওজন হ্রাস, দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা এবং সন্ধ্যার জ্বর আপনার সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়, তবে দেরি না করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
মনে রাখবেন, অ্যাবডোমিনাল টিবি একটি নীরব অনুপ্রবেশকারী হতে পারে, কিন্তু সচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসায় এই শত্রুকে পরাজিত করা সম্ভব।
আপনার শরীরের ‘ইঞ্জিন রুম’কে সুরক্ষিত রাখুন, সুস্থ থাকুন।