নবজাতক – ৩ মাস
সদ্য জন্মানো শিশু কথা বলার সময় আপনার মুখের ভঙ্গি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখবে এবং আপনি কোন সুরে তার সাথে কথা বলছেন তা লক্ষ্য করতে শুরু করবে। অনেক সময় ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে শিশু হয়তো প্রথমবার আপনার দিকে তাকিয়ে হাসবে। যখন সে কান্নাকাটি করে এবং আপনি তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন, তখন আপনার কণ্ঠ শুনেই সে অনেকটা শান্ত হয়ে যাবে।
৩ থেকে ৬ মাস
নবজাতকের ঘুমকাতুরে স্টেজ থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে শিশু তার আশেপাশে আরো বেশি লক্ষ্য করতে শুরু করবে। ৪ মাসের মধ্যে সে তার চোখ দিয়ে ঘুরন্ত বস্তু যেমন, ফ্যান বা নড়াচড়া করে এমন ধরনের খেলনা অনুসরণ করতে শুরু করবে এবং আপনার মুখ আরো কাছে থেকে দেখার চেষ্টা করবে। এসময় শিশু শব্দ হয় এমন খেলনা এবং গানে মনোযোগ দিতে শুরু করে।
৬ মাসের মধ্যে আপনার ছোট্ট শিশুটি আপনার আবেগ অনুভূতি টের পাবে। তাতে সাড়াও দিতে শুরু করবে। এমনকি এসময় তার নাম ধরে ডাকলে সে সাড়া দেবে এবং কোন আওয়াজ শুনলে সেও শব্দ করে জবাব দেবে যা শিশুর আদেশ বুঝতে পারার সক্ষমতা অর্জনের ছোট্ট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
৬ – ১২ মাস
শিশুর প্রথম বছরের দ্বিতীয় ৬ মাসে শিশু ধীরে ধীরে তার চারপাশের পরিবেশ বুঝতে এবং তার সাথে তাল মেলাতে শুরু করে। কোনো শব্দ হলে সে সেদিকে ঘুরে তাকায়। আপনি যখন ওর নাম ধরে ডাকবেন তখন সে আপনার দিকে তাকাবে। আপনার সাথে যোগাযোগ করার সময় প্রায়ই সে হাসবে।
যে শব্দগুলো আপনি ওর সামনে বেশি বলেন সেগুলো থেকে কয়েকটি শব্দ সে বুঝতে পারবে এবং কোনো দিকে তাকানোর জন্য ইশারা করলে সে ওই দিকে তাকাবে। শিশু ৯ মাসের মধ্যে “না” এর অর্থ কী তা বুঝতে পারবে যদিও আপনি কোনো কিছু করতে “না” করলে সব সময় সে সেটা সবসময় মানবে না।
যখন শিশুর প্রথম জন্মদিন ঘনিয়ে আসবে অর্থাৎ শিশুর যখন প্রায় ১ বছর হয়ে আসবে তখন সে আপনার কথার মধ্যে যে অনুরোধ থাকবে এবং অঙ্গভঙ্গির মধ্যে যে নির্দেশ থাকবে তা বুঝতে পারবে।যেমন এই সময় সে “টা-টা” বা “বাই-বাই” দিতে পারবে।এমনকি আপনি যে কথাগুলো বলছেন সেগুলোও বলার চেষ্টা করবে। এই বয়সে সে প্রথমবারের মতো বেশ কয়েকটি শব্দ বলতে পারে।দাদা, বাবা, আতা, নানা, মামা কিংবা আক্কা, আপ্পা এরকম শব্দ এখন আপনি প্রায়ই শুনবেন।
১২ – ১৮ মাস
এই বয়সে আপনার শিশু হাই, আসি, যাই– এই ধরনের একটি শব্দ ব্যবহার করে নিজে নিজে কথা বলতে শুরু করবে, কিন্তু বুঝতে পারবে আরো অনেক বেশি।
এ সময়ে ধীরে ধীরে সে অনেকগুলো শব্দ বলা শিখে যাবে। যে জিনিসগুলো সাধারণত প্রতিদিন ব্যবহার করা হয় সেগুলো চিনতে পারবে। যেমন: চুল আঁচড়ানোর চিরুনি, ব্রাশ, মাথার টুপি, পানি খাওয়ার গ্লাস।
শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন হাত, পা, চোখ, কান, নাক চিনবে এবং দেখাতে পারবে। এছাড়াও বই বা ছবি থেকে বিভিন্ন বস্তু, মানুষ, পশুপাখি চিনবে এবং দেখাতে পারবে। পাশাপাশি দুটি শব্দ দিয়ে তৈরি কথাও বুঝতে পারবে; যেমন বাবার টুপি বা মায়ের ওড়না।ওকে সহজ নির্দেশনা দিলে সেটা করতে পারবে। যদি বলা হয় “জুতাটি খোলো” বা ‘হাত তুলো’ তাহলে সে সেটা করতে পারবে।
১৮ – ২৪ মাস
শিশুর দ্বিতীয় জন্মদিন প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে, এই সময়ে আপনার এই দ্রুত বেড়ে ওঠা শিশু একটি স্পঞ্জের মতো।স্পঞ্জ যেরকম সবকিছু দ্রুত শুষে নেয়, শিশুও এখন যা শুনবে তাই গ্রহণ করবে, শিখবে। এ বয়সে তার শব্দ বোঝার ক্ষমতা থাকে আকাশচুম্বি। খুব দ্রুত সে শত শত শব্দ বুঝতে পারবে, যদিও সে এখনই সেগুলো সবগুলো বলতে পারবে না। যদি কোনো একটা জিনিসের নাম ভুল বলা হয় সে তাও বুঝতে পারবে।
যেমন আপনি যদি কুকুরকে দেখিয়ে বলেন এইটা প্লেন, এটা যে ভুল সেটা সে বুঝবে।
২ বছর বয়সের মধ্যে সে একসাথে দুটি নির্দেশ বুঝতে পারবে এবং অনুসরণ করতে পারবে। যেমন, যদি বলেন- তোমার পুতুলটা আনো এবং সেটা ঝুড়িতে রাখো, এই বয়সে সে এটা করতে পারবে।
২৪ – ৩৬ মাস
বিদেশে এ বয়সে বাচ্চাকে প্রি-স্কুলে দেয়ার সময় হয়। শিশুর আদেশ এবং দিকনির্দেশনা বোঝার ক্ষমতা বেশ বাড়তে থাকে। সে খুব দ্রুত নতুন নতুন শব্দ এবং ধারণা শিখতে থাকে এবং খুব পরিচিত মানুষ ও বস্তুর নাম বলতে পারে যেমন-বিভিন্ন গাছ, ফল, ফুলের নাম। এমনকি এ বয়সে শিশু তার নিজের নাম ও বয়স বলতে পারে। শিশু তার ৩ বছর বয়স হতে হতে ২ বা ৩ ধাপে বিভিন্ন নির্দেশ অনুসরণ করতে পারে।
শিশুকে আপনি কী বলছেন তা বুঝতে সাহায্য করার জন্য এবং আপনার আদেশ অনুসরণ করতে সাহায্য করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো শিশুর গ্রহণযোগ্য ভাষার দক্ষতার (receptive language) বিকাশ ঘটানো । এজন্য শিশুর সাথে প্রচুর কথা বলতে হবে। আপনি যত বেশি কথা বলবেন তার ভাষা দক্ষতা ততো বেশি বাড়বে। যার ফলে আপনি কিছু বললে বা কোন নির্দেশ দিলে সেটা সে বুঝতে এবং করতে পারবে।
কিভাবে শিশুর সাথে কথা শুরু করবেন যদি বুঝতে না পারেন, নিচের কৌশলগুলো অনুসরণ করতে পারেন।
আপনি সারাদিন কী কী করেছেন সেটা শিশুর কাছে বর্ণনা করুন। আপনি যখন শিশুকে নিয়ে বাড়ির চারপাশে হাঁটবেন বা ঘুরতে বের হবেন তখন কী করছেন এবং কী দেখছেন তা বর্ণনা করুন।
প্রতিটা জিনিসের আলাদাভাবে নাম দিন। যেন শিশু পরবর্তীতে সেই নাম অনুযায়ী সেগুলোকে চিনতে পারে। বিভিন্ন রঙের নাম বলুন এবং জিনিসের আকার চেনান। যেমন কোনটা গোল আর কোনটা চারকোণা সেগুলো বলুন। শিশু যে খেলনা দিয়ে খেলে সেই খেলনাগুলোর নাম বলুন। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় যদি কোন কুকুর দেখেন তাহলে সেটাও চেনান যে এটা কুকুর।
সহজ কথা বলুন। পরিস্কারভাবে সুন্দর করে বর্ণনা করবেন এবং একটা কথা বারবার বলবেন যেন সে শব্দগুলো অর্থসহ বুঝতে পারে। কোন শব্দ দিয়ে কী বোঝাচ্ছেন সেটা যেন সে ধরতে পারে।
নাম ধরে কথা বলুন। আমি,আমাকে,সে,তাকে,এটা,ওটা এমন ধরনের সর্বনাম ব্যবহার না করে ‘নাম’ ধরে কথা বলার চেষ্টা করুন। যেমন “ওটা” দাও না বলে “বল”টা দাও এবং “আমাকে” বলটা দাও না বলে, “মাকে” বলটা দাও বললে তার বুঝতে সহজ হয়।
যেহেতু আপনার শিশু এখন ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে,তার ভাষা দক্ষতা বাড়াতে প্রশ্ন তাকে খুব সাহায্য করবে।ওকে এখন অনেক অনেক প্রশ্ন করুন।
“হ্যাঁ” বা “না” প্রশ্ন। যে প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না দিয়ে দেওয়া যায় শিশুকে তেমন প্রশ্ন করুন। যেমন- “এটা কি একটা চামচ?” আবার কিছু বোকা বোকা প্রশ্নও করতে পারেন, যেমন- “পাখি কি উড়তে পারে?” এ ধরনের প্রশ্নে শিশু চটপট সাড়া দেবে।
যে প্রশ্ন শিশুকে বাছাই করাার সুযোগ দেয়।“তুমি কি আম খাবে, না কলা?” বা “তুমি লাল জামা পড়বে না সবুজ জামা?”—এ ধরনের প্রশ্ন শিশুকে বাছাই করার সুযোগ দেয়। এতে সে বুঝতে পারে যে সে যে উত্তরটি দেবে সেটাই সে পাবে।
একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার পর, আপনার বাচ্চাকে উত্তর দেওয়ার জন্য সময় দিন। সে উত্তরটি দেওয়ার পর তার প্রশংসা করুন এবং তাকে নিশ্চিত করুন যে সে সঠিক উত্তরটি দিয়েছে। যেমন- তুমি একদম ঠিক বলেছো, পাখি উড়তে পারে।
কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে
অন্যান্য আরো মাইলফলকের মতো, আপনার সন্তানের বোঝার এবং যোগাযোগ করার ক্ষমতা তার নিজের সময় মত হবে। কিন্তু যদি আপনার সন্তানের বিকাশ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা থাকে, তাহলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করুন।
আপনি যদি নিচের কোন একটি লক্ষণ শিশুর মধ্যে দেখেন তবে ডাক্তারের সাথে কথা বলা খুবই জরুরী।
১৮ মাসের মধ্যে: আপনার সন্তান যদি কাউকে অনুকরণ না করে, নতুন শব্দ না শেখে, কমপক্ষে ৬ টি শব্দ বলতে না পারে অথবা আপনাকে দেখানোর জন্য হাত দিয়ে কোনদিকে নির্দেশ না করে।
২৪ মাসের মধ্যে : একটা সাধারণ জিনিস (যেমন- চিরুনি/ ব্রাশ) দিয়ে কী করতে হয় সেটা যদি না জানে, দুই-শব্দের বাক্যাংশ না বলে বা একদম সাধারণ নির্দেশ অনুসরণ করতে না পারে।
৩৬ মাসের মধ্যে: আপনার শিশু যদি বাক্যে কথা বলতে না পারে বা সহজ নির্দেশনাবলী না বুঝে।
আপনার মনে এখন প্রশ্ন জাগতে পারে শিশুর বিকাশের পরবর্তী ধাপ কী হবে। শিশু ৩ বছর বয়স থেকে স্কুলে যাক বা বাড়িতে থাক, সেখান থেকেই তার ভাষা দক্ষতা আরো বিকশিত হতে থাকে।
পরবর্তী ধাপে আপনি শিশুকে অন্য ঘর থেকে ডাকলে সে আপনার ডাকে সাড়া দেবে, বিভিন্ন রঙ চিনবে ও জিনিসের আকার বুঝতে পারবে এমনকি পারিবারিক সম্পর্কগুলোও বুঝতে পারবে। যেমন- দাদি, বড় ভাই, ছোট বোন।
এই সময়ে তার অভিব্যক্তিপূর্ণ ভাষা (expressive language) অর্থাৎ কথা বলা ও আদেশ-নির্দেশ অনুসরণ করার দক্ষতার সমন্বয় শুরু হবে। যখন আপনার সন্তানের বয়স ৪ বছর হবে তখন সে যে শুধু নির্দেশনা বুঝে কাজ করতে পারবে তাই-ই নয়, সে নিজেও আপনাকে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে শুরু করবে।
এ লেখাটি আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পিডিয়াট্রিকস (AAP) এর গাইডলাইনের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে।