আমাদের দেশে মলদ্বার সম্পর্কিত রোগগুলোর মধ্যে ফিশার (Anal Fissure) একটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও সাধারণ সমস্যা। লজ্জা ও সংকোচের কারণে অনেকেই এ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেন না এবং অবহেলা করেন। কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা না নিলে ফিশার দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় পরিণত হতে পারে এবং জীবনযাত্রার মান নষ্ট করে দিতে পারে।
এটি ভয়ের কিছু নয়, কারণ প্রাথমিক অবস্থায় সঠিক চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে ফিশার থেকে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব।
ফিশার কী?
ফিশার হলো মলদ্বারের ভেতরের আস্তরণে (Anal Canal lining) একটি ছোট ও সরু কাটা বা ক্ষত। এটি সাধারণত শক্ত বা শুকনো মলত্যাগের সময় হয়। এই ক্ষতটি ছোট হলেও প্রচণ্ড ব্যথা ও রক্তপাত ঘটায়।
ফিশারের প্রকারভেদ
একিউট ফিশার (Acute Fissure): নতুন ও সাম্প্রতিক ক্ষত, সাধারণত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়।
ক্রনিক ফিশার (Chronic Fissure): দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা ফিশার, যেখানে ক্ষত গভীর হয় এবং পাশেই একটি মাংসপিণ্ড বা স্কিন ট্যাগ দেখা দিতে পারে।
ফিশারের কারণ ও ঝুঁকির কারণসমূহ
ফিশার হওয়ার পেছনে মূলত কোষ্ঠকাঠিন্য ও মলত্যাগের সময় অস্বাভাবিক চাপ দায়ী। অন্যান্য কারণও রয়েছে—
🔴 দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য – শক্ত মল পাস করার সময় মলদ্বারের আস্তরণ ফেটে যায়।
🔴 ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা – বারবার পাতলা পায়খানার কারণে মলদ্বার উত্তেজিত হয়ে ক্ষত হয়।
🔴 মলত্যাগে অতিরিক্ত চাপ – জোর করে চাপ দিলে ফিশারের ঝুঁকি বাড়ে।
🔴 শিশু ও গর্ভবতী মা – শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য ও গর্ভাবস্থার কারণে চাপ বৃদ্ধি ফিশারের কারণ হতে পারে।
🔴 মলদ্বারের রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়া – বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী রোগীদের ক্ষেত্রে।
🔴 আঘাত – মলদ্বারে কোনো ইনজুরি বা দুর্ঘটনা হলেও ফিশার হতে পারে।
ফিশারের লক্ষণসমূহ
ফিশার খুব ছোট একটি ক্ষত হলেও এর লক্ষণগুলো অত্যন্ত অস্বস্তিকর—
⏺️ তীব্র ব্যথা – মলত্যাগের সময় ও পরে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া বা ছুরিকাঘাতের মতো ব্যথা হয়।
⏺️ রক্তপাত – মলের সাথে বা টয়লেট টিস্যুতে উজ্জ্বল লাল রক্ত দেখা যায়।
⏺️ চুলকানি ও জ্বালা – মলদ্বারের চারপাশে অস্বস্তি ও চুলকানি হয়।
⏺️ ফোলা বা ছোট মাংসপিণ্ড – দীর্ঘদিনের ফিশারে মলদ্বারের মুখে স্কিন ট্যাগ বা ফোলা দেখা যায়।
⏺️ ভয়জনিত কোষ্ঠকাঠিন্য – তীব্র ব্যথার কারণে রোগী মলত্যাগ এড়িয়ে চলে, ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য আরও বেড়ে যায়।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা
✅ ওষুধ ও ক্রিম: ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে স্থানীয় মলম, নাইট্রোগ্লিসারিন অয়েন্টমেন্ট, লিডোকেইন জেল, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার অয়েন্টমেন্ট ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
✅ সাপোজিটরি ও জোলাপ: মল নরম করার জন্য জোলাপ বা স্টুল সফটেনার দেওয়া হয়।
✅ বোটক্স ইনজেকশন: গুরুতর ক্ষেত্রে মলদ্বারের পেশি শিথিল করার জন্য প্রয়োগ করা হয়।
✅ সার্জারি (Lateral Internal Sphincterotomy): দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল ফিশারের জন্য অস্ত্রোপচার করা হয়, যেখানে মলদ্বারের স্পিঙ্কটার পেশি কেটে দেওয়া হয় যাতে চাপ কমে যায়।
ন্যাচারাল ও লাইফস্টাইল চিকিৎসা
👉 উচ্চ আঁশযুক্ত খাবার: শাকসবজি, ফলমূল, ডাল, গমের আটা ও ইসবগুলের ভুসি খাওয়া।
👉 পর্যাপ্ত পানি পান: দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি খেলে মল নরম থাকে।
👉 সঠিক টয়লেট অভ্যাস: মলত্যাগের বেগ এলে দেরি করবেন না এবং টয়লেটে বেশি সময় বসবেন না।
👉 সিজ বাথ (Sitz Bath): কুসুম গরম পানিতে দিনে ২–৩ বার ১৫ মিনিট বসলে ব্যথা ও ফোলা অনেকটা কমে যায়।
👉 হালকা ব্যায়াম: নিয়মিত হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করে।
প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা
- ফিশার অনেকাংশেই প্রতিরোধযোগ্য।
- নিয়মিত আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া
- পর্যাপ্ত পানি পান
- কোষ্ঠকাঠিন্য এড়িয়ে চলা
- দীর্ঘসময় বসে না থাকা
- সঠিক টয়লেট অভ্যাস গড়ে তোলা
এসব অভ্যাস মেনে চললে ফিশারের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
শেষ কথা
ফিশার একটি সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত বেদনাদায়ক রোগ। ছোট ক্ষত হলেও এটি অবহেলা করলে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে জটিলতায় পরিণত হতে পারে। তাই মলদ্বারে ব্যথা বা রক্তপাত দেখা দিলে লজ্জা না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সঠিক সময়ে চিকিৎসা ও জীবনযাত্রায় সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে ফিশার থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
সচেতন থাকুন, স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলুন, আরামদায়ক জীবন উপভোগ করুন।